মফস্বল সংবাদকর্মীরাই গণমাধ্যমের মেরুদণ্ড


এম সুজন আকন, দৈনিক আলোকিত সময়


এম সুজন আকন : মফস্বল সাংবাদিকদের সমালোচনায় লিপ্ত থাকে মফস্বল সাংবাদিকরাই। এটা এখন আর নতুন কিছু নয়। ইদানিং দেখা যায়, মফস্বল সাংবাদিকদের তুমুল সমালোচনায় লিপ্ত হচ্ছে ঢাকার অভিজাত সাংবাদিকরাও। গেল সপ্তাহে সিনিয়র এক সাংবাদিক তার ফেসবুক পেইজে মফস্বলে অপসাংবাদিকতার দৌড়াত্ম বেড়ে যাওয়া নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন। 

সেখানে তিনি তুলে ধরেছেন, মফস্বল সাংবাদিকের একাধিক সমালোচনা। সেই পোস্টে কমেন্ট করেছেন ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষেরা। কমেন্টগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাংবাদিকদের মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

ওই পোস্টটিতে যারা সাংবাদিকদের খাটো করে নানা রকম কমেন্ট করেছেন, সম্প্রতি পুলিশ কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গণমাধ্যমকর্মী গোলাম রাব্বীকে নির্যাতনের ঘটনায় তাদের কিছু লিখতে বা প্রতিবাদ করতে দেখিনি। প্রতিবাদ যতটুকু উঠেছে তা কেবল সাংবাদিকদের পক্ষ থেকেই। কারণ পেশায় রাব্বী ব্যাংকার হওয়ার পাশাপাশি সে একজন গণমাধ্যমকর্মীও। এজন্যই হয়তো দায়িত্ববোধের কারণে সাংবাদিকরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
যা বলছিলাম, গোলাম রাব্বি তো আবার ঢাকার সাংবাদিক তাই হয়তো তার ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ সাংবাদিকরা করেছে। কিন্তু তিনি যদি ভাগ্যক্রমে মফস্বল সাংবাদিক হতো তাহলে প্রতিবাদে হয়তো আর কাউকে পেলেও সাংবাদিক পাওয়া যেতো না। শুধু রাব্বিই নয়, প্রতিদিন মফস্বলে সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাই একজন মফস্বল সাংবাদিক তার প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ আর সামান্য সহযোগিতা অন্য পেশার মানুষের কাছ থেকে কি পেতে পারে না?

জনগণের চোখে কালি দিয়ে সরকারের টাকা লুটে নিচ্ছে, আর সেই ছবি তুলতে গিয়ে ন্যাড়ি কুত্তার মতো মার খেয়ে পিঠের ছাল হারাচ্ছে মফস্বল সাংবাদিক। আর তখন সেই জনগণের মুখে শোনা যায় ‘আহ বেচারা চাঁদাবাজি করতে গিয়ে কতই না মার খেলো’। হিসেব করে দেখলাম, সব কিছুর পেছনে এলার্জি শুধু সাংবাদিকরাই।

আজ সাংবাদিকদের অপরাধ দুর্নীতি নিয়ে কোথাও লেখা দেখলে সেখানে অন্য পেশার মানুষরা সক্রিয়ভাবে সাংবাদিকদের মর্যাদা ক্ষুণœ করার কামান নিয়ে হাজির হন। একজন মফস্বল সাংবাদিকের লেখার মাধ্যমে একটি এলাকা, গ্রাম, উপজেলা এমনকি একটি জেলার বৃহত্তম উন্নয়ন হয় তারা সেটা মানতে নারাজ। আর সেটা শুধু অন্য পেশার মানুষই নয় এ পেশার বড় বড় কর্তারাও মানতে নারাজ যে, মফস্বল সাংবাদিক একটা মিডিয়ার অংশ। তাদের একটা রিপোর্টে একটি মিডিয়া মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

কেউ কি লক্ষ্য করে দেখেছেন? একটি জাতীয় দৈনিকের ৪০ ভাগ নিউজ থাকে মফস্বল সাংবাদিকের লেখা। আর বেশিরভাগ দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন থাকে ৫০ ভাগেরও বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় তাদের কতটা মূল্যায়ন করা হয়? ভালো একটা নিউজ লিখলে ধন্যবাদ পাওয়ার সৌভাগ্যও হয় না মফস্বলের সাংবাদিকের। সাংবাদিকদের বেতন ভাতা নিয়ে যে ৭ম ওয়েজ বোর্ড ও ৮ম ওয়েজ বোর্ড দেখা যায়। দুঃখের বিষয় সেখানে কোন জেলা বা উপজেলা প্রতিনিধির মর্যাদা ও গ্রেড বলে কোন শব্দের দেখা পায়নি মফস্বল সাংবাদিকরা।

সংক্ষেপে মফস্বল সাংবাদিকের হাতে উন্নয়নের একটি গল্প বলবো, ২০০৭ সালের কথা। পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা ও বরগুনাসহ উপক‚লের উপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় সিডর। এবিষয়ে কয়েকজন মফস্বল সাংবাদিক লিখেন উপক‚লের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সচিত্র সংবাদ। বিশেষ করে দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক এম জসীম উদ্দিন তার মিডিয়ায় লিখেন উপক‚লের বিশেষ কিছু সংবাদ। আর সেসব লেখার ওপর ভিত্তি করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিদেশি সংস্থা ছুটে আসেন ক্ষতিগ্রস্ত ও স্বজনহারা মানুষের পাশে। 

অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা থেকে শুরু করে নগদ অর্থ দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। শুধু ওই সময়ই নয়। ২০০৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সেই সব সংগঠন ও এনজিও উপক‚লের মানুষদের নিয়ে কাজ করছে।

তার লেখার মর্যাদা হিসেবে তিনি প্রথম আলোর সেরা প্রতিবেদকের পুরস্কার পেয়েছেন করেকবার। কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনও ক্ষতিগ্রস্ত কারো কাছ থেকে শোনা যায়নি, সাংবাদিকদের কারণে তারা আজ উপকৃত। জানি এটা কখনো কেউ বলবে না। কারণ, ভালো কাজে উৎসাহ দেয়ার মতো মানুষের বড় অভাব।

এবার বলবো টেলিভিশনে মফস্বল সাংবাদিকতা। প্রায়ই টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখা যায় দেশের এ প্রান্তে সড়ক দুঘটনায় অনেক মানুষের প্রাণহানি। আবার দেখা যায়, লঞ্চডুবিতে অনেক মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। যে কোনো নির্বাচন চলাকালে সবশেষ খবরের শিরোনামও দেখা যায় সবার আগে টেলিভিশনে। এছাড়াও দেশের যে কোন প্রান্তের খবর তাৎক্ষণিক স্থান পায় টেলিভিশনে। আর সেই সংবাদ দেখে বেশিরভাগ দর্শকই মূল্যায়ন করে ওইসব টেলিভিশন কতটা স্ট্যান্ডার্ড এবং দ্রুতগতির এবং কতটা বস্তুনিষ্ঠ। কিন্তু কেউ কি ভেবেছে, ওই সংবাদগুলো মফস্বল সাংবাদিকের পাঠানো? হয়তো দর্শকের এই বিষয়টি ভাবার সময় থাকে না। 

তাই বলে কি ওই টেলিভিশনের কর্তারাও ভাববে না? দুঃখের বিষয়, ওই সময় তাদেরকে ফোন করে একটা ধন্যবাদ দেয়ারও প্রয়োজনবোধ মনে করে না বেশিরভাগ টেলিভিশনের কর্তাব্যক্তিরা। যার একটি সংবাদে টেলিভিশন দর্শকদের আলোচনার কেন্দ বিন্দু হয়ে ওঠে, যার পাঠানো একটি শিরোনামে দর্শকদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে একটি টেলিভিশন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু সেই তুলনায় তাদেরকে কতটা মূল্যায়ন করা হয়?

বড় কষ্টে বলতে হয়, মোবাইলে কথা বলতে গিয়ে প্রতি মিনিটে আমরা ভ্যাট দেই, এমনকি একজন মাদকাসক্ত মানুষ প্রতিটা সিগারেটে সরকারকে ভ্যাট দিয়ে থাকে। কিন্তু দেখা যায় যাদের দেয়া ভ্যাট দিয়ে মাস গেলে যে সব কর্তাদের বেতন হয় সেই কর্তাদের কাছে সেবা নিতে গিয়ে হতে হয় হয়রানির শিকার। এক কথায় বলা যায় ‘আমার বিলাই আমারে কয় মেও’।

একটি কথা বলতে খুব খারাপ লাগছে। যারা মফস্বল সাংবাদিকদের নিয়ে বিভিন্ন সময় খারাপ মন্তব্য করেন তারা জেনে রাখবেন, কোন সাংবাদিক ভালো মানুষের কাছ থেকে টাকা নিতে পারে না। যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকে তারা নিশ্চয়ই দুর্নীতিগ্রস্ত। আর সে কাজটা শুধু সাংবাদিকরাই না অন্য পেশার মানুষেরাও করে। পুলিশ, এমপি, মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে আরো অনেকে। শুধু তফাৎ তারা সরকারি সব সুবিধা পায় আর সাংবাদিকরা পায় বঞ্চনা।

তবে হ্যাঁ, সাংবাদিকরা যে খারাপ কাজ করে না তা বলছি না। তারাও খারাপ কাজ করে। তবে সেটা সবার বেলায় বালা উচিত। কেননা প্রতিবাদ না থাকলে সমাজ থেকে ‘খারাপ’ শেষ করা যাবে না। মফস্বলে কিছু হলুদ সাংবাদিকের কারণে সকল সাংবাদিকরা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকেই আজ সাংবাদিকতার নাম ব্যবহার করে জরিয়ে পরছে নানা অপকর্মে। তাই খারাপকে খারাপ বলা আর ভালোকে ভালো বলার অধিকার প্রতিটা মানুষের আছে।

তাই সংবাদকর্মী হিসেবে অন্য সব পেশার মানুষদের বলছি, যখন কোন সমস্য নিয়ে মানববন্ধন মিছিল মিটিং করেন, তখন কিন্তু ওই মফস্বল সাংবাদিকরাই আপনাদের সংবাদটি দেশের উচ্চ পর্যায়ের মানুষের কানে পৌঁছে দেয়। অতএব প্রতিবাদের সময় পেশা ভুলে সকলে মিলে খারাপকে খারাপ আর ভালোকে ভালো বলার সৎ সাহসটুকু তৈরি করাও সকল মানুষের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। আর মফস্বল সাংবাদিকের নির্যাতনের প্রতিবাদ ও সহযোগিতায় পাশে দাঁড়াবে সকল পেশার মানুষ এমনটাই প্রত্যাশা মফস্বলের সকল সাংবাদিকের।

লেখক : মফস্বল সম্পাদক, দৈনিক আলোকিত সময়

মন্তব্যসমূহ