এম সুজন আকন
করোনাকালীন ঈদের পরে এক মফস্বল সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি খুব দুঃখ নিয়ে বলছিলেন, ‘ভাই কি আর বলবো, অফিস থেকে বিজ্ঞাপন ম্যানেজার ফোন করেছে।
মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে আমি ও আমার পরিবার কেমন আছি তার খোঁজ নেওয়াতো দূরের কথা, তিনি আমাকে ঈদ উপলক্ষে এক লাখ টাকার শুভেচ্ছা বিজ্ঞাপন চাইছেন। অথচ আমি বিগত দিনে যে বিজ্ঞাপন পাঠিয়েছি তার প্রায় দুই আড়াই লাখ টাকা কমিশন আটকে আছে। আজ দিবো কাল দিবো করে দিচ্ছে না।
আমরাওতো মানুষ, আমাদেরও পেট আছে, পরিবার আছে। আমাদেরতো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। এই পেশায় এ পর্যন্ত এসে, না পরি পেশাটা ছাড়তে না পারি ধরে রাখতে।’
আড্ডায় আমাদের মাঝে যখন গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় তখন সবার মুখে একই কথা, শুধুই ‘হতাশা’। কারো মুখেই যেন আশার কোন সুর নেই। এই গণমাধ্যমে ছাটাই, ওই গণমাধ্যমের বেতন বন্ধ, সেই গণমাধ্যমে অস্থিরতা। এ যেন সবার কথাতেই ‘হাই প্রেসার’।
এই সব ‘হাই প্রেসার’ চলা গণমাধ্যমে কর্মরত সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝতে পেরেছি তা হলো, গণমাধ্যমের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মফস্বল সাংবাদিকদের পদে পদে বঞ্চিত করা। এছাড়াও অপেশাদার কিছু ব্যক্তিকে মফস্বলে প্রতিনিধি হিসেবে গুরুত্ব দেয়াও ওই সব গণমাধ্যমের অস্তিত্ব হারানোর একটি বিশেষ কারণ বলে আমি মনে করি।
নিজে যেহেতু মফস্বলে সাংবাদিকতা করেছি তাই এই বিভাগটিতে আমার একটু বেশিই আগ্রহ থাকে। তাই কৌতুহল থেকে ‘হাই প্রেসার’ চলা গণমাধ্যমে কর্মরতদের কাছে জানতে চাইলাম আপনাদের মফস্বল বিভাগের হালচাল কি? বেশিরভাগ সহকর্মীদের কাছ থেকে বহু দৈন্যদশার কথা শুনলাম। পত্রিকার অর্থ সংকটের মূল কারণগুলোর মধ্যে আমার কাছে মফস্বলের বিজ্ঞাপনের কমিশন না দেওয়ার বিষয়টি অন্যতম মনে হয়েছে।
এছাড়া আরো বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে, বেতন ভাতা না দেওয়া, মূলধারার সাংবাদিকদের অবমূল্যয়ন, অপেশাদার ব্যক্তিকে আইডি কার্ড ধরিয়ে সাংবাদিক বানানো ও মফস্বলের সংবাদের গুরুত্ব না দেওয়াসহ বহু কারণ।
যারা নিয়মিত পত্রিকা পড়েন তারা হয়তো লক্ষ্য করে দেখবেন প্রতিটি পত্রিকায় যেসব বিজ্ঞাপন থাকে তার বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন মফস্বলের। এসব বিজ্ঞাপন কিন্তু মফস্বলের সাংবাদিকরাই সংগ্রহ করেন। মূলত মফস্বলে একটা পত্রিকায় যাকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তিনি শুধু সাংবাদিকই নয়, একাধারে বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন এক্সিকিউটিভও।
যাইহোক মূল কথায় আসি, বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটা পত্রিকা বেসরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে থাকেন। বাকি সব পত্রিকার প্রধান আয় সরকারি বিজ্ঞাপন। বর্তমানে যেসব পত্রিকা অর্থসংকটে রয়েছে এর বেশিরভাগ পত্রিকায় খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের মফস্বল সাংবাদিকদের সঙ্গে উল্লেখিত এসব বৈষম্য করা হচ্ছে। বেতন ভাতাতো দূরের কথা, তারা যে সরকারি অফিসগুলোতে ঘুরে ঘুরে জুতা ক্ষয় করে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে আনেন তার কমিশনটাও ঠিকমত দেন না ওই সব পত্রিকা কর্তৃপক্ষ।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে বেতন ভাতা যেহেতু পাচ্ছে না তাহলে মফস্বল সাংবাদিকরা চলেন কি করে? ইনকাম সোর্স কি? বলে রাখা ভালো বেশিরভাগ মফস্বল সাংবাদিকদের বর্তমান রোজগার হলো বিজ্ঞাপনের কমিশন। মফস্বল থেকে যে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে তারা পাঠান তার ১৫% থেকে ৩০% পর্যন্ত কমিশন ভালো গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ দিয়ে থাকেন। আর এই কমিশনই তাদের প্রধান রোজগার।
এই রোজগার নিয়ে যেসব পত্রিকা কর্তৃপক্ষ টালবাহানা করেন তাদের বলবো, মফস্বল সাংবাদিকতাকে আপনাদের মত কিছু গণমাধ্যম গলা টিপে শেষ করেছেন। আজ থেকেই এসব থেকে সড়ে আসুন। মফস্বল সাংবাদিকতাকে বাঁচান, তাদের বেতন ভাতা ও বিজ্ঞাপনের কমিশনসহ সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করুন এখনই।
অন্যদিকে মফস্বল সাংবাদিকদের বলবো- যে গণমাধ্যম আপনাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত ঘটায় সেখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব চলে যান। বাঁচার মত বাঁচুন, টিকতে না পরলে সময় থাকতে পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যান তবুও কারো ব্যবহারের শিকার হবেন না।
আজকাল ফেসবুকে প্রায়ই অনেকে বলেন- ‘ভাই একটা কার্ড দেন, সাংবাদিক হবো’। এখনও জেগে থেকেও যারা স্বপ্ন দেখেন মফস্বল সাংবাদিক হওয়ার, তাদের বলছি- জীবন একটা, তাই পেশা বাছাইয়ে একটা ভুল সিদ্ধান্ত আপনার জীবনকে দুর্বিষহ করে দিতে পারে। গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই খারাপ, এরমধ্যে মফস্বলের অবস্থা আরো করুন। আমার মতে যারা এখনও এ পেশায় আসেননি তারা এর থেকে দূরে থাকুন, এতে আপনার মঙ্গল হবে। আর যদি মফস্বলে সাংবাদিকতা করতেই হয়, তবে প্রথমে এ বিষয়টি নিয়ে পড়া-লেখা করুন। সিনিয়রদের সঙ্গে মিশুন, বোঝার চেষ্টা করুন পেশার বর্তমান পরিস্থিতি কি। সব থেকে ভালো হয় বিকল্প পেশা হিসেবে এটা নিতে পারলে। শিক্ষকতা, আইন পেশা ও ব্যবসার পাশাপাশি মফস্বলে সাংবাদিকতা করতে পারেন।
সর্বশেষ কথা হলো- অনেক খারাপ খবরের মাঝেও যেমন ভালো খবর থাকে, তেমনি গণমাধ্যমের এই দুর্দিনেও অনেক গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে আসছেন। নিয়মিত বেতন-ভাতা, বিজ্ঞাপন কমিশনসহ নানা সুযোগ সুবিধাও বহু গণমাধ্যম দিয়ে থাকেন। কিন্তু লাখ লাখ মফস্বল সাংবাদিকদের মাঝে হাতে গোনা কয়েকজন ভালো থাকলে সেটাকে ভালো বলা যায়? তবুও পরিবার নিয়ে ভালো থাকুক এ পেশার লাখ লাখ মফস্বল সাংবাদিক। আর মৃত্যু হোক মফস্বল সাংবাদিকতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া ‘গণমাধ্যমের কালো বিড়াল’গুলোর।
লেখক : সিনিয়র সহ-সম্পাদক ও ইনচার্জ, মফস্বল বিভাগ, দৈনিক জাগরণ
suzanbarguna@gmail.com

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন